পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির আত্নচেতনা ও মনোতৃপ্তির এক অন্যতম দিন। এছাড়া বাঙালির একীভূত হওয়ার এক উৎসব না বললে অসমাপ্ত রয়ে যাবে কথাটা।
পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের নামটায় যেনো বাঙালির ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সুগন্ধ মিশে আছে। তাই তো আমরা তার আভাস পাই প্রকৃতির মাঝে, আকাশে বাতাসে। অন্যদিকে আধুনিকতার শহরের বুকেও একদিনের জন্য বাঙালির হয়ে সেজে উঠে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বয়সের ছাপ পড়া মানুষটিও। পহেলা বৈশাখ
চারিদিক যেনো হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবাই একটাই নামে নিজেকে পরিচয় দেয় আমি বাঙালি, আমি উজ্জীবিত এক প্রাণ যেখানে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা টকবক করছে। কিন্তু এই পহেলা বৈশাখ কেনো বাঙালির চেতনা, কেনো অসাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া বলা হয়? পহেলা বৈশাখ
আপনি হয়তো অনেক বর্ষ পঞ্জিকার কথা শুনেছেন। আর এই অন্যান্য বর্ষ পঞ্জিকা কোনো না কোনোভাবে কোনো ধর্মকে কেন্দ্র করে তার বহিপ্রকাশ। কিন্তু একমাত্র এই পহেলা বৈশাখ, যাকে আমরা নববর্ষ বলে জানি, তা শুরু হয়েছে শুধু বাঙালিয়ানার উপর ভিত্তি করে। কোনো ধর্মকে কেন্দ্র করে নয়।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাংলা সনের সাথে হিজরী এবং খ্রিষ্টীয় সনের মধ্যে পার্থক্য দুইটি। হিজরী সন নির্ধারণ করা হয় চাঁদের উপর নির্ভর করে ও খ্রিষ্টীয় সন নির্ধারণ করে থাকে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী।
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। এদিন সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না হয়ে সূর্যোদয় থেকে শুরু হয়। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে রয়েছে ভিন্নমত। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে মিল রেখে রাত ১২.০০ টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়ে থাকে। এ আরেক বিতর্ক। নববর্ষ উৎসবটি একইসাথে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নববর্ষ উৎসব হিসেবে পরিচিত যুগ যুগ ধরে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার গান গেয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এ গানের কোনো সুর নেই। এছাড়া নববর্ষে দোকানে দোকানে হালখাতার প্রচলন চালু হয় অনেক আগে থেকেই। এ দিনে পুরোনো সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করারও দিন এটি। আমরা যে মাছে-ভাতে বাঙালি তাও আমাদের জানান দিয়ে যায় বাংলার এই নতুন বছর। পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ আর ভাতের আয়োজন করা হয় বাড়িতে বাড়িতে, বিভিন্ন আধুনিকতার ছোঁয়া দামি দামি হোটেলগুলোতে। বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে মেলার আয়োজন। পহেলা বৈশাখের মূল আকর্ষনই হলো মনোমুগ্ধকর শোভাযাত্রা, বটগাছের মেলা, পান্তাভাত খাওয়া। শতশত মানুষের ভিড়ে যেনো নিজের সব পরিচয় হারিয়ে আমিও এক আদর্শ বাঙালি হয়ে তাদের মাঝে নিজেকে মিলিয়ে ফেলি।
চারিদিকে শুধু রঙিনে রঙিনে আর নানান রকম ঢাক-ঢোলের শিল্পকর্ম ফুঁটে উঠে কাপড়ে কাপড়ে। বাংলাদেশ, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা হয়ে উঠে একই আত্নার প্রতীক। আমিও সেই একই আত্নার প্রতীক বলছি। আমি আমার এই বাঙালিয়ানাকে ছড়িয়ে দিবো পুরো বিশ্বে। আমার বাঙালি সংস্কৃতি আমার অহংকার, এ আমার এক চেতনা। যেখানে আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আর তা প্রবলভাবে জানান দিয়ে যায় আজকের এই পহেলা বৈশাখ। কিন্তু এই আধুনিকতার ছোঁয়ায় পহেলা বৈশাখ শব্দটি টিকে থাকলেও তার বাঙালি ঐতিহ্য তুলে ধতে ভুলে যাবে না তো?
শোভাযাত্রা একসময় আধুনিক গানের তালে তালে যাত্রা হয়ে যাবে না তো? আগে গ্রামে-গ্রামে শহরের আনাচে-কানাচে মেলা চোখে পড়তো। বাঙালি ঐতিহ্য যদি দর্শন করতে চান তা ছিলো একমাত্র মেলার আসর। কিন্তু এখন তা আর চোখে পড়ে না। এখন যার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে। অন্যদিকে বাড়ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রচারের স্বার্থে বিভিন্ন আয়োজন। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান, কিছু খেলনার দোকান চোখে পড়ে, লোকসমাগম হয়। কিন্তু এ মেলা বাঙালি জাতির সেই ঐতিহ্যবাহী মেলা নয়। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্যগুলো৷ একসময় কি সব বিলীন হয়ে যাবে? এ ভয় গোটা বাঙালি জাতির অস্তিত্ব যারা রক্ষা করতে চায় তাদের মনে। কিন্তু শুধু পহেলা বৈশাখে নয় সারাবছরেরই বাঙালির ঐতিহ্য তুলে ধরা আমাদের কর্তব্য। বাঙালির সেই সংস্কৃতিগুলো টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব।